উন্নতমানের বেগুন চাষ পদ্ধতি ও বালাই দমন

বেগুন চাষ কিভাবে করতে হয়?
https://www.sbdfoodtips.xyz/2023/07/Improved-eggplant-cultivation-methods-and-pest-control.html

বেগুন বাংলাদেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি  সবজি। প্রায় সারা বছরই এর চাষ করা যায়। নিরাপদ বেগুন চাষের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- জাত ও জাতের বৈশিষ্ট্য, বালাই দমন ও সার প্রয়োগ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য । যা আমাদের আজকের প্রতিবেদনে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল।

বেগুনের জাতের নাম কি?

বাংলাদেশে গড়ে মিলে প্রায় শতাধিক জাতের বেগুন পাওয়া  যায়। যেমন- পটলা, ঝুপি, তারাপুরী, কাজলা,  ইসলামপুরী  নয়নতারা, খটখটিয়া, শিংনাথ এসব স্থানীয়, স্থানীয় উন্নত, বারি ও হাইব্রিড জাত সারা দেশে প্রায় সারা বছরই চাষ করা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের তীব্রতার বিবেচনায় বেগুনের অবস্থান শীর্ষ পর্যায়ে। বেগুনের জাতভিত্তিক রোগ ও পোকা আক্রমণের তীব্রতা নিচে আলোচনা করা হলো।

চারা উৎপাদন ও সার প্রয়োগ

জমি তৈরি :  প্রথমে আগাছা বেছে মাটি তৈরি করতে হয়। শীতকালীন বেগুন আগস্ট-অক্টোবর  এবং বর্ষাকালীন   বেগুন জানুয়ারি-এপ্রিলে বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। গড়ে মিলে ২৫ গ্রাম বীজ ৩ বর্র্গ মি. বীজতলায় বুনতে হয়। বীজতলায় ৫০ মেস নাইলন নেট দিয়ে ঢেকে চারা উৎপাদন করলে চারা অবস্থায় ভাইরাস প্রতিরোধ করা যায়। গজানোর   ১০-১২ দিন পর চারা দ্বিতীয় বীজতলায় লাগানো যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে চারার বয়স ৩০-৪০ দিন অথবা   ৪-৬টি পাতা হলে রোপণ করতে হবে। 

সার : জাতের ফলন ক্ষমতা ও অপুষ্টি লক্ষণমাথায় রেখে সার প্রয়োগ করতে হবে।  তবে গাছে অপুষ্টি লক্ষণ দেখে সার ও চুন  প্রয়োগ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বেগুনের রোগ  দমন ব্যবস্থাপনা  

https://www.sbdfoodtips.xyz/2023/07/Improved-eggplant-cultivation-methods-and-pest-control.html


> গোড়া পচা, ঢলেপড়া ও ক্ষুদে পাতা রোগ : গোড়া পচা দমনের জন্য অটোস্টিন মাত্র ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। ঢলেপড়া রোগ ও খাটো আকৃতির পাতা রোগ দমনে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকনাশক এবং ভাইরাস বাহক সাদামাছি ( ইমিটাফ/নাইট্রো প্রয়োগ) করলে দমন করা সম্ভব।

 > ফমপসিস রোগ (Phomopsis) : ফমপসিস রোগ দমনে বীজ শোধন করার জন্য গরম পানিতে ( ৫১ডিগ্রি সে) ১৫ মিনিট রাখা, অটোস্টিন ০.১ গ্রাম/৫০ গ্রাম বীজ, মূূল জমিতে অটোস্টিন ১০ গ্রাম/৫লিটার পানি মিশিয়ে স্প্রে  করে বেগুন গাছে দিতে হবে।


>ডেম্পিং অফ বা চারা ধ্বসা/ঢলে পড়া রোগ : বেগুনের বীজতলায় ‘ডেম্পিং অফ’ ছত্রাক রোগের আক্রমণ হয়। এটি আক্রমণে চারার কাণ্ড ও শিকড়ে  রোগ ছড়িয়ে চারা  মারা যায়। রোভরাল (২ গ্রাম/লি) বা কম্প্যানিয়ন (২ গ্রাম/লি) ৮ দিন পর পর প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে অটোস্টিন  দিয়ে  বীজ শোধন  করলেএই রোগের প্রাদুর্ভাব কম থাকে।

বেগুনের পোকা

বেগুনে বিভিন্ন ধরনের পোকা বসবাস করে । ফল ও কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা, মেলিবাগ, বিটল, সাদা মাছি ও জেসিড ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব পোকা দেখা গেলে যথানিয়মে ট্রেসার ২টি স্প্রে করতে হবে তারপর  মারশাল এই চক্র অনুসরণ করে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।     

আরো পড়ুন করলা চাষে অধিক ফলন পেতে করণীয়  

https://www.sbdfoodtips.xyz/2023/06/Method-of-Cultivation-of-Bitter-gourd.html

> বেগুনের ডগা ও ফলের মাজরা পোকা :  বেগুনের মাঝরা পোকা খুবই মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে।এই পোকার আক্রমণ অধিক হলে এই পোকা দ্বারা সর্বাধিক ৬৩% পর্যন্ত ফলন ক্ষতি হতে পারে। বেগুন ছাড়াও এ পোকা টমেটো, আলু, মটরশুটি সহ বিভিন্ন সবজিকেও আক্রমণ করতে পারে। প্রকার আক্রমণে ফল বিস্বাদ, খাওয়ার অনুপোযুক্ত হয়ে যায়। বেগুনের ডগা ও ফল মাজরা পোকা গাছে মাটি থেকে নেয়া পানি চলাচল ব্যহত  করে এবং ডগা, পাতা ঢলে পড়ে মারা যায়। মাজরা পোকার ছিদ্রের মুখে কীড়ার মল দেখা যায়।  আক্রমণে গাছে ফুল ধরতে বিলম্ব হয়। ক্রীড়া ফুলের কুঁড়ি এবং পরে বৃতির মাধ্যমে বর্ধনরত ফলের মধ্যে প্রবেশ করে এবং বর্ধনরত ফল আক্রান্ত হলে তাতে ছিদ্র দেখা যায়। বেগুনের এই একটি পোকা দমন করতে ১-২টি ফসল মৌসুমে গড় দৈনিক হিসাবে প্রায় শতাধিক বার অতি বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে করার উদাহরণ রয়েছে। অথচ আশ্চর্য বিষয় বায়োলজিক্যালি অতি কম বিষাক্ত ট্রেসার প্রয়োগ করে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তা দমন করা সম্ভব।

>ট্রেসার মার্শাল প্রয়োগ : চারা রোপণের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে জমিতে মথ দেখার সাথে সাথে ট্রেসার প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৪ মিলি হারে স্প্রে করতে হবে। জমিতে  প্রকার লক্ষণ দেখা দিলে  সাথে সাথে আক্রান্ত ডগা অপসারণ করে একই হারে পুনরায় ট্রেসার প্রয়োগ করতে হবে। এর ৭-১০ দিন পর মার্শাল ২০ ইসি ১০ লিটার পানিতে ৩০ মিলি মিশিয়ে স্প্রে  করা যেতে পারে।  বিশেষ করে রোপণের কয়েক দিন পর থেকেই এ পোকার আক্রমণ হয় এবং শেষ ফলটি সংগ্রহ করার আগ পর্যন্ত এর আক্রমণ চলতে থাকে।  গ্রীষ্মকালীন জীবনচক্র সম্পন্ন করতে এই প্রকার ২০-৩০ দিন এবং শীতকালে ৩৪-৪৫  দিনের মতোলাগে।  তবেবছরে এরা ৫ বা  এর বেশি বংশবিস্তার করতে পারে। মে-অক্টোবর ৩টি বংশ এবং নভেম্বর-এপ্রিল মাসের মধ্যে ২টি বংশবিস্তার  করে থাকেন। স্ত্রী মথ পোকা পাতার উল্টো দিকে, কুঁড়িতে, বোঁটায় ও ডগায় ডিম পাড়ে। গ্রীষ্মকালে ৩-৫ দিন এবং শীতকালে ৭-৮ দিনের ভিতর ডিম ফুটে কীড়া বের হয়।   

সমম্বিত বালাই দমন  

বেগুন ক্ষেতে প্রতি সপ্তাহে পোকার উপস্থিতি পরীক্ষা করতে হবে। পোকায় আক্রান্ত ডগা ও  ফল কীড়াসহ ছিঁড়ে মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। তবে নিরাপদ বেগুন উৎপাদনে ব্যাগিং ও অর্গানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। বেগুনের জমি গভীরভাবে চাষ করে-মই দিয়ে সমান করে আগাছামুক্ত করতে হবে। বেগুনের জমি স্বল্প ব্যয়ে আগাছামুক্ত রাখতে চাইলে চারা রোপণের ২-৩ দিনের মধ্যে মাটিতে পানিডা ৩৩ ইসি বিঘাতে ৩০০ মিলি প্রয়োগ করা যেতে পারে। জমি তৈরির শেষ চাষে কার্বোটাফ ৫জি ১.৫ কেজি/ প্রতি বিঘাবিঘা দিতে হবে।  সঠিক মাত্রায়সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষ করে ইউরিয়া অতিরিক্ত দেয়া যাবে না। রোপণের ১৫ দিন থেকে সপ্তাহে অন্তত একদিন ক্ষেতে জরিপ করতে হবে। ক্ষেত আগাছানাশক (পানিডা) দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ফুল আসার আগে বেগুন গাছের ডগা বা পাতায় পোকা দেখলে পোকা ধ্বংস করাসহ বালাইনাশক দিতে হবে।

 বেগুন গাছে কি করতে হবে?

নিরাপদ বেগুন চাষে কিছু বাড়তি পরিচর্যা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। যেমন : হরমোন (বায়োজাইম/ওকোজিম)। তরল জৈবসার প্রয়োগ। শিকড় অধিক বিস্তৃত করা। ফলের আকার ও ওজন  বৃদ্ধি করা। ফুল ধরার সময় ১ বার, ১ম স্প্রে করার ২১ দিন পর এবং ৪২ দিন পর  স্প্রে করা যেতে পারে। মিরাকেল গ্রো/বায়োলিনফা/জোবস/সুপার থ্রাইব/বুস্ট পেক রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১০-১৫ দিন পরপর ৪-৫ বার দিলে বিঘাপ্রতি ১৫-২৫ মিলি প্রয়োগ করতে হবে।  তবে খেয়াল রাখতে হবেরোগা গাছে হরমোন দেওয়া যাবে না।     

বেগুন ছায়ায় রাখলে গরমকালে  গড়ে১-৩ দিন  এবংশীতে কালে ৩-৫ দিন সতেজ থাকে। ১৩ সেন্ট্রিগ্রেড তাপে ও ৯০% আর্দ্রতায় ২৫ দিনপর্যন্ত হ্যালো হ্যালো রাখা যায়     

সারণি : উফশী জাতে সার

সারের নাম পরিমাণ/টব পরিমাণ/হেক্টর

গোবর/ কম্পোস্ট ১.৫ কেজি, ১০,০০০ কেজি

ইউরিয়া ৪০ গ্রাম ৩০০ কেজি

টিএসপি ৪০ গ্রাম ২৫০ কেজি

এমওপি ৩০ গ্রাম ২০০ কেজি

জিপসাম ৬ গ্রাম ১০০ কেজি

বোরিক এসিড (বোরন) - ১০ কেজি

বীজ উৎপাদনে করণীয়

পরিপক্ব ফল হলদে রংঙ্গের হলে সংগ্রহ করা। সপ্তাহপর ফলের চামড়া ছিলে বীজসহ মাংসল অংশ কেটে ২৪ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে। তারপর রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা ৮% হবে।     

পরিশেষে বিটি বেগুন ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ। যা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত করা হয়েছে। বিটি (ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস) ব্যাকটেরিয়া থেকে জিনকে পৃথক করে বেগুনে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। এই জিন বেগুনে পোকানাশক প্রোটিন তৈরি করে যা ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকাকে প্রতিরোধ করে। বারি জাত, ছিদ্রপোকা-ট্রেসার, সুষম সার দ্বারা এভাবে বেগুন চাষ করে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্বব।


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post

Advertisement

Advertisement